123 views
in মুসলিম ইতিহাস by (38 points)
মিশরে মুরসির পতন কেন হয়েছিল? এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা কর সংক্ষিপ্তভাবে।

1 Answer

0 votes
by (494 points)

ভূমিকা: ১৯৮১ সালে আনোয়ার সাদাত মৃত্যুবরণ করলে মিশরের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় স্বৈরশাসক হুসনে মোবারক। হুসনে মোবারকের স্বৈরাচারী শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে জনগণ তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। একবিংশ শতকের শুরুর দিকে সালের এই আন্দোলন চরম রূপ নেয়। যার ফলে হুসনে মোবারক ক্ষমতা শতান্ত্রিক থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়। ২০১২ সালের ১ জুলাই মিশরের প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন ড. মুরসি। ড. মুরসির ক্ষমতায় আসা মিশরের জনগণের মনে আশার আয় খুবই আলো সঞ্চার করেছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন সামরিক সরকারের হাতে এর ক্ষমতা শাসিত মিশরে হঠাৎ গণতান্ত্রিক সরকারের আগমনকে সেনাবাহিনী ভালো চোখে দেখেনি। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও সামরিক বাহিনীর গৃহযুদ্ধ উচ্চাভিলাষ ড. মুরসীর পতনকে ত্বরান্বিত করে।
ড. মুরসির পতনের কারণ: ড. মুরসির পতনের পেছনে এই পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি নানাবিধ বৈদেশিক ষড়যন্ত্রও দায়ী। নিম্নে তা প্রদত্ত হলো:

(ক) অভ্যন্তরীণ কারণ: ড. মুরসির পতনের পেছনে যে সমস্ত ষড়যন্ত্র ও সমস্যা দায়ী সেগুলো উল্লেখ হলো: যথা-

১. হঠাৎ নতুন গণতান্ত্রিক সরকারের আবির্ভাব: মিশর এটি ব্যাপক দীর্ঘকাল যাবৎ সামরিক শাসক দ্বারা শাসিত হয়ে আসছিল সেখানে হঠাৎ করে গণতান্ত্রিক সরকারের আবির্ভাবকে সামরিক ছে। হুতি জান্তারা ভালো চোখে দেখেনি। হুসনে মোবারকের দীর্ঘকালীন লীদি আরব সামরিক শাসকের ফলে সামরিক জান্তারা সরকারের অনুগত হয়ে ল সেখানে পড়ছিল, যার ফলে সর্বক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়ে ত, সেখানে যায়। জনগণের ভোটাধিকারে নির্বাচিত মুরসি সরকার স্বাভাবিকভাবেই নানারূপ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়।

২. সেনাবাহিনীর নানারূপ ষড়যন্ত্র: ড. মুরসির পতনের নৈপথ্যে যে কারণটি সবচেয়ে বহুল আলোচিত সেটি হচ্ছে মিশরীয় সেনাবাহিনীর নানারূপ ষড়যন্ত্র। সেনাবাহিনী মুরসির আবির্ভাবের পূর্বে সকল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করত। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটতো। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার আসার ফলে সেনাবাহিনী একটু বিপাকে পড়ে যায়। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। যার ফলে সেনাবাহিনী মুরসির পতনের জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়, যা সামরিক অভ্যুত্থানের জন্ম দেয়।

৩. সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাস: মিশরীয় শাসন ছিল সামরিক জান্তাদের শাসন। মুরসির আগমনের পূর্বে সেখানে কোনো নির্বাচিত সরকার ছিল না। সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে কার্যকর ছিল। এতে ক্ষমতার প্রতি সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষ সৃষ্টি হয়। আকস্মিক ক্ষমতার হস্তান্তর তারা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। তারা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতকল্পে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

৪. ইসলাম বিদ্বেষীদের অব্যাহত ষড়যন্ত্র: ড. মুরসি শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে মিশরে ইসলামি আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ইসলাম বিদ্বেষীরা ভীত হয়ে পড়ে। তারা মুরসির সরকারের বিরুদ্ধে নানারকম গুজব ছড়িয়ে মিশরের জনগণকে সুসংগঠিত করে তুলে। এমনকি নানা জায়গায় ইসলাম বিদ্বেষীদের সাথে ব্রাদারহুডের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার নাম করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয়।

৫. ভঙ্গুর অর্থনীতির প্রভাব: হুসনে মোবারকের শাসনামলে মিশরের অর্থনীতিতে ভঙ্গুর অবস্থা বিরাজ করছিল। মুরসির সরকার এই ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনর্গঠনের কাজে মনোনিবেশ করলেও পুরোপুরি সফলতা দেখাতে পারেনি। মিশরের এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা মুরসির দোসররা জোরালোভাবে প্রচার করতে থাকে। এভাবেই তারা বিভিন্ন অপপ্রচারের মাধ্যমে জনতার মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। আর এ সুযোগে সেনাবাহিনী শাসনক্ষমতা দখল করে নেয়।

৬. নাস্তিক্যবাদী শক্তির উত্থান: মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মিশরে নাস্তিক্যবাদী শক্তির প্রভাব ছিল অনেক বেশি। দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসকগণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার কারণে সেখানে রাষ্ট্রীয় জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই ধর্মের প্রভাব সৃষ্ট হয়নি। এমনকি সামরিক বাহিনীর মধ্যে অবাধ, অবৈধ খোলামেলা, মদ ও জুয়া ইত্যাদির প্রভাব ছিল খুব বেশি। তাছাড়া ও মিশরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও নাস্তিক্যবাদী মনোভাব পোষণ করতেন। তাই হঠাৎ একটি মুসলিম সরকারের আবির্ভাব হলে তারা নানারূপ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

৭. সুদীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার অভাব: ড. মুরসির পতনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে- মুরসি সরকার ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ না করে তড়িগড়ি সব কাজকর্ম করতে থাকেন। মিশরের প্রশাসনের একটি বড় অংশ ছিল মোবারকপন্থি। মুরসি সরকার তাদেরকে কাটছাঁট করার ব্যাপারে প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় দেয়নি। মুরসী সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও সুদীর্ঘ পরিকল্পনার অভাবে ব্রাদারহুডের ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যায়।

(খ) বৈদেশিক কারণ: ড. মুরসির পতনের পেছনে যে সমস্ত বৈদেশিক কারণ দায়ী তা প্রদত্ত হলো:

১. ইসরাইলের চক্রান্ত: মিশরের পার্শ্ববর্তী দেশ ইসরাইল। ইসরাইল কখনোই চায় না মিশরে কোনো মুসলিম শক্তিশালী সরকার ক্ষমতায় আসুক। কেননা এই সরকার ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব বা অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই মুরসির ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইসরাইল নানাবিধ চক্রান্ত করতে থাকে। এই চক্রান্তের অংশ হিসেবে ইসরাইল পাশ্চাত্য শক্তিকে মুরসির উৎখাতের নিমিত্তে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিল।

২. সৌদি আরবের গোপন ষড়যন্ত্র: ড. মুরসির আগমনের পেছনে সৌদি আরবের নানামুখী ষড়যন্ত্রও অনেকাংশে দায়ী ছিল। মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড ছিল একটি জনপ্রিয় সরকার। ব্রাদারহুড মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতেও দলটির শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সচেষ্ট ছিল। ব্রাদারহুডের এ সমস্ত কর্মকাণ্ড ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের পতনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ালে সৌদি রাজপরিবার চিন্তিত হয়ে পড়ে। তারা মিশরে সামরিক অভ্যুত্থানে সামরিক বাহিনীকে এক বিরাট অর্থ প্রদান করেছিল।

৩. ড. মুরসির পাশ্চাত্য বিমুখ মনোভাব: ড. মুরসি স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমাদের বিশ্বাস করতেন না। তিনি তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর পরই তুরস্ক, ইরান ও চীন সফর করেন। এতে পশ্চিমা সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তারা মুরসির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের জন্য নানামুখী ষড়যন্ত্রে  লিপ্ত হয়। এই ষড়যন্ত্রের ফলে মুরসির সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয়।

8. USA কর্তৃক মিশরীয় সেনাবাহিনীকে আর্থিক সহায়তা: মিশরের সেনাবাহিনী প্রতি বছর USA থেকে পেয়ে থাকে ১২০ এ কোটি ডলারের ঘুষ। তারা এই সহায়তাটি পেয়ে থাকে পূর্বের - প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের আমল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র - কর্তৃক এ সহায়তা মিশরীয় সেনাবাহিনী তাদের অঘোষিত দাস বানিয়ে ফেলে। এমতাবস্থায় তারা যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশের বাইরে - যাওয়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ইঙ্গিত প্রদান করা মাত্রই তারা অভ্যুত্থানের সৃষ্টি করে।

৫. সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে পশ্চিমা সমর্থন: মিশরে ক সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে পূর্ণ সমর্থন প্রদান করেছিল পশ্চিমা র দেশগুলো। ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও টনি ব্লেয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়েছিল। তার এই সমর্থন সামরিক কম বাহিনীকে ক্ষমতা দখলে অনুপ্রাণিত করে। মুরসির গণতান্ত্রিক সরকারের পতনের পেছনে পশ্চিমা মদদও বহুলাংশে দায়ী।

৬. সুয়েজ খালের আধিপত্য নিয়ে বিরোধ: এশিয়া ও উত্তর নয় আফ্রিকার সাথে ইউরোপের যোগাযোগের একমাত্র নৌপথ সুয়েজ খাল। এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। সুয়েজ খালটি একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ছিল মিশরের হাতে। তদুপরি মুরসির লী সরকার ক্ষমতায় আসার পর নানাবিধ বিধিনিষেধ আরোপ করে। বে এ সমস্ত কারণে পাশ্চাত্যের দেশগুলো মুরসির উপর ক্ষিপ্ত হয় এবং তাকে সরানোর নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

৭. ইসলাম বিদ্বেষী সংস্থাগুলোর আর্থিক যোগান: মিশরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুসলিম সরকারকে আনোয় উৎখাতের জন্য ইসলাম বিদ্বেষী সংস্থাগুলো উঠে পড়ে লেগে যায়। হিসেনে তারা তাদের স্বার্থের নিমিত্তে জনগণকে মুরসি বিরোধী আন্দোলনে শামিল করার জন্য হাজার হাজার কোটি ডলার অর্থের যোগান দিয়েছিল। এমনকি তারা সামরিক অভ্যুত্থান নিশ্চিত করার জন্য সামরিক বাহিনীকেও মোটা অঙ্কের অর্থ প্রদান করে। ফলে মুরসির সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান সংঘটিত করে। 

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বহুল প্রত্যাশিত ব্রাদারহুড সরকার মুরসির আবির্ভাবে মিশরের রাজনীতিতে সদা স পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। কিন্তু পরবর্তীতে সেই ছোঁয়া স্থায়ী হয়নি। সেখানে মুরসিকে মুখোমুখি হতে হয় নানারূপ ষড়যন্ত্রের। দেশি-বিদেশি ইসলাম বিদ্বেষী সংস্থাগুলো উঠে পড়ে লেগে যায়। তারা মুরসির সরকারের অপপ্রচার চালিয়ে জনগণকে মুরসির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে থাকে। অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইঙ্গিতে সেনাবাহিনী মুরসিকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নিলে মিশরের গণতন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

Related questions

...