ইমাম আল-গাজ্জালী (১০৫৮-১১১১ খ্রিস্টাব্দ) ইসলামের অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক, তাত্ত্বিক, এবং সূফি চিন্তাবিদ। তাঁর জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology) ইসলামী দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আল-গাজ্জালীর জ্ঞানতত্ত্বে তিনি জ্ঞান অর্জনের উৎস, প্রক্রিয়া এবং মানদণ্ড নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা তার প্রধান বইগুলোতে যেমন ইহয়া উলুম আদ-দীন, তাহাফুত আল-ফালাসিফা, এবং মিশকাত আল-আনওয়ার-এ প্রতিফলিত হয়েছে।
আল-গাজ্জালী বিশ্বাস করতেন যে জ্ঞান তিনটি প্রধান উৎস থেকে আসে:
আল-গাজ্জালী জ্ঞান অর্জনের জন্য কয়েকটি স্তর নির্ধারণ করেছিলেন:
আল-গাজ্জালী মনে করতেন যে জ্ঞানের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করা। তিনি বলেছেন, জ্ঞান মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটায় এবং সত্যিকারের হেদায়েতের পথ দেখায়। তাঁর মতে, যে জ্ঞান মানুষকে আল্লাহর দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়, তা মূল্যহীন।
আল-গাজ্জালী যুক্তি ও বুদ্ধির গুরুত্ব অস্বীকার করেননি, তবে তিনি মনে করতেন যে বুদ্ধি একা চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছাতে অক্ষম। আধ্যাত্মিক জ্ঞানই (তাসাউফ) সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে। তাঁর মতে, হৃদয়ের পরিশুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে জ্ঞানী হওয়া সম্ভব।
আল-গাজ্জালী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ তাহাফুত আল-ফালাসিফা (The Incoherence of the Philosophers)-এ গ্রিক দর্শনের সমালোচনা করেন। তিনি আরিস্টটল, আল-ফারাবি, এবং ইবনে সিনার মতো দার্শনিকদের অনেক মতবাদ খণ্ডন করেন। আল-গাজ্জালী যুক্তি দেন যে শুধুমাত্র যুক্তি এবং দর্শনের মাধ্যমে ঈমান বা সত্য অর্জন সম্ভব নয়।
আল-গাজ্জালীর জ্ঞানতত্ত্ব ইসলামী বিশ্বে শুধু নয়, পাশ্চাত্য চিন্তাধারাতেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। তিনি জ্ঞানের উৎস এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে গভীর আলোচনা করেছেন এবং আধ্যাত্মিকতা ও যুক্তির মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আজও দার্শনিক, ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক আলোচনায় প্রাসঙ্গিক।
আল-গাজ্জালীর জ্ঞানতত্ত্ব ইসলামের গভীরতম দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোকে সহজভাবে উপস্থাপন করেছে। তাঁর চিন্তাধারা দেখায় যে জ্ঞান শুধু বুদ্ধি বা অভিজ্ঞতার বিষয় নয়, এটি আত্মার গভীরতার সাথেও জড়িত। তাঁর তত্ত্ব জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, যা বর্তমান যুগেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।